বছরের পর বছর একই কর্মস্থলে কারারক্ষীরা
১৩ বছর নিরুদ্দেশ থেকেও কর্মরত * অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে টিকে থাকা মুশকিল * বন্দিদের চিকিৎসায় অবহেলা
প্রথা অনুযায়ী কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একই কর্মস্থলে স্বাভাবিকভাবে দুই বছর পর্যন্ত থাকতে পারেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র এর উলটো। এমন ৭৪ জনের একটি তালিকা যুগান্তরের হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২১ বছরের বেশি সময় ধরেও কোনো ব্যক্তি একই কর্মস্থলে কর্মরত আছেন। এ ছাড়া কেউ ১৯ বছর, কেউ ১৭ বছর, কেউ ১৬ বছর, আবার কেউ ১৪ বছর ধরে একই কর্মস্থলে। ১৩ বছর, ১২ বছর, ১০ বছর, নয় বছর ও আট বছরের বেশি সময় ধরে একই কর্মস্থলে আছেন অনেকে। এক জায়গায় সাত বছর পার হয়েছে-এমন কয়েকজনের তথ্যও যুগান্তরের হাতে এসেছে। এছাড়া বছরের পর বছর নিরুদ্দেশ থেকেও চাকরিতে বহাল আছেন কেউ কেউ। আবার কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় কয়েক মাসের মধ্যেই কর্মস্থল ত্যাগ করতে হচ্ছে কাউকে কাউকে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কারারক্ষী জোবায়েদ হোসেন প্রায় ১৩ বছর ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। ২০১০ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে তিনি নিরুদ্দেশ। অফিসের নথি অনুযায়ী তিনি ঢাকায় ২১ বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত। প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, তিনি ঢাকায় যোগ দেন ২০০১ সালের ২ সেপ্টেম্বর। ডেপুটি জেলার জগন্নাথ দাস কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং পটুয়াখালী জেলা কারাগারসহ কয়েকটি স্থানে কর্মরত ছিলেন। সবশেষ কর্মরত ছিলেন শেরপুর জেলা কারাগারে। ২০২০ সালের ৩ মার্চ থেকে তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত। অনুপস্থিত থাকার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছয় মাসের মধ্যে ৩-৪টি চিঠি দেওয়া হয়। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট থানা থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করে চাকরিচ্যুতিসংক্রান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জগন্নাথ দাস যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে আমেরিকায় অবস্থান করছেন। কারাসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বন্দি নির্যাতন বন্ধ, মাদক প্রতিরোধ এবং বন্দিদের বাসস্থান ও চিকিৎসার মান উন্নয়নসংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়ায় সহকারী সার্জন, ডিপ্লোমা নার্স/চিকিৎসা সহকারীকে প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটছে। যারা কারা অভ্যন্তরের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করেন তাদের মধ্যে অন্যতম নার্সিং কর্মকর্তা (ডিপ্লোমা নার্স) আফজালুর রহমান। তিনি অসুস্থতার কারণে ৫ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের বাইরে চিকিৎসারত ছিলেন। দেশে ফিরে কর্মস্থলে যোগদানের পরপরই তাকে কারা হেডকোয়ার্টার্সে সংযুক্ত করা হয়। তিনি নরসিংদীতে কর্মরত ছিলেন মাত্র ১০ মাস। নরসিংদী সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার (সহকারী সার্জন) ডা. মোহাম্মদ মাহমুদুল কবীর বাসার কারাগারের রিপোর্ট/মিনিট (পরামর্শ) বইয়ে কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বেশ কিছু নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এ কারণে তাকে সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে ন্যস্ত করে ২ জানুয়ারি কারা অভ্যন্তরে সহকারী সার্জনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডা. মোহাম্মদ মাহমুদুল কবীর বাসার ৩ ডিসেম্বর কারাগারের পরামর্শ বইয়ে লেখেন, ‘নরসিংদী জেলা কারাগারে বন্দিদের মধ্যে স্ক্যাবিস (চুলকানি) এবং সব ধরনের চর্মরোগের প্রাদুর্ভার দেখা দিয়েছে। এ রোগ দিন দিন বাড়ছে। এ বিষয়ে ১ আগস্ট কারা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সিভিল সার্জন মহোদয়ও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের কথা উল্লেখ করে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানানো হলেও কারা কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে কারাগারের চিকিৎসা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।’ ওইদিন তিনি পরামর্শ বইয়ে অপর এক মন্তব্যে লেখেন, ‘অদ্য (গত ৩ ডিসেম্বর) নরসিংদী জেলা কারাগারে রোগী দেখার সময় কয়েদি ইফতেহার রাসেল আমার কাছে চিকিৎসা নিতে আসে। সে জানায়, সর্বপ্রধান কারারক্ষী হেলাল উদ্দিনের নির্দেশে সহকারী প্রধান কারারক্ষী আবু তাহের তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। এমতাবস্থায় এ ধরনের বিষয়ের প্রতি বিধি মোতাবেক সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হলো।’
গত ১৬ নভেম্বর নরসিংদী সিভিল সার্জন ডা. মো. নুরুল ইসলাম ও নরসিংদী সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ মাহমুদুল কবীর স্বাক্ষরিত পরামর্শপত্রে বলা হয়, ‘বন্দিদের চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং বিষয়ে মৌখিকভাবে জেলার এবং জেল সুপারদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বন্দিদের চিকিৎসা দেওয়ার সময় দেখা যায় যে, কিছু বন্দি মাদক সেবন ও এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে কারা অভ্যন্তরে অবস্থান করছে। মাদকাসক্ত বন্দিদের নিয়ে কর্মশালা/কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম করতে ২-৩ মাস ধরে জেলার রিজিয়া বেগমকে বলা হলেও তিনি কোনো কর্ণপাত করেননি। বরং বিষয়টি নিরুৎসাহিত করেছেন। চিকিৎসাসংক্রান্ত এবং বন্দিদের বসবাসের ক্ষেত্রে মান উন্নয়নমূলক পরামর্শ বাস্তবায়ন না হওয়ায় কারাগারের স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে।’
প্রাপ্ত নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯ বছরের বেশি সময় ধরে এই কর্মস্থলে কর্মরত আছেন কারারক্ষী মোজাম্মেল হক। ১৮ বছর ধরে বর্তমান কর্মস্থলে আছেন কারারক্ষী ফারুক সরকার। সাড়ে ১৬ বছর ধরে একই কর্মস্থলে কর্মরত আছেন কারারক্ষী মাহতাব উদ্দিন ও আপেল মাহমুদ। মাহতাব উদ্দিন প্রেষণে কারা অধিদপ্তরে থাকলেও আপেল মাহমুদ ২০০৯ সালের ১০ মে থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত।
১৪ বছরের বেশি সময় ধরে একই কর্মস্থলে আছেন কারারক্ষী শওকত আলী গাজী, আব্দুল খালেক, গোলাম মোস্তফা ও মনোয়ার মোল্লা। ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে নিরাপত্তা সেলে কর্মরত আছেন কারারক্ষী পারভেজ মিয়া ও কাজী রিপন। সাড়ে ১২ বছর ধরে একই কর্মস্থলে আছেন কারারক্ষী আল আমিন। সাড়ে ১১ বছর ধরে এক কর্মস্থলে আছেন কারারক্ষী মাহবুব আলম। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এক জায়গায় আছেন কারারক্ষী মোফাজ্জল হোসেন, মোয়াজ্জেম হোসেন, মুনসুর আলী, হারুন অর রশীদ রিপন কুমার তালুকদার ও চাঁন মিয়া। নয় বছরের বেশি সময় ধরে যারা একই কর্মস্থলে কাজ করছেন তাদের মধ্যে আছেন-কারারক্ষী আলোয়ার হোসেন, আ. লতিফ, মো. মাসুদ এবং আব্দুল হান্নান সরদার। আট থেকে নয় বছর পর্যন্ত একই কর্মস্থলে আছেন-কারারক্ষী সোহেল রানা, জাকির হোসেন, আনোয়ার হোসেন, মো. রায়হান, আবুল কালাম, মাসুদ পারভেজ, শাহ আলম, শফিকুল ইসলাম দিপু ও মুক্তাজুল ইসলাম।
সূত্র জানায়, প্রায় আট বছর ধরে একই কর্মস্থলে আছেন কারারক্ষী হেদায়েত উদ্দিন সজিব মিয়া, জাহিদুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, মিলন মোল্লা, সুজন শেখ, জমরুদ হোসেন, রফিকুল ইসলাম, মহিউদ্দিন, কামরুজ্জামান, ফিরোজ মাহমুদ, মোজাম্মেল হক, আল মামুন, রবিউল ইসলাম, আহসান হাবীব, কালাম সিকদার, নাসির শেখ, মেহেদী হাসান ও জাহাঙ্গীর হোসাইন। প্রায় সাত বছর ধরে একই কর্মস্থলে আছেন কারারক্ষী লিয়াকত আলী, লুৎফর রহমান, খোকন মিয়া, ইউসুফ আলী, জহিরুল ইসলাম, আতাউর রহমান, মোবারক হোসেন, রুহুল আমিন, কামরুজ্জামান, হানিফ হোসেন খান, ইসলাম উদ্দিন, রাসেল শিকদার, রফিকুল ইসলাম (ঢাকা), রফিকুল ইসলাম (ময়মনসিংহ), আশিয়াকুল্লাহ, আরিফ হোসেন গাজী, নাঈম মোল্যা, রহমত উল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, মোক্তার হোসেন ও ফজলুর রহমান।
এ বিষয়ে ডিআইজি (প্রিজন্স) ফজলুল হক যুগান্তরকে বলেন, পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের সুনির্দিষ্ট বিধি নেই। সাধারণত দুই-তিন বছরের বেশি কোনো কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এক জায়গায় রাখি না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বছরের পর বছর যারা একই কর্মস্থলে কর্মরত আছেন তাদের বিষয়ে একটি তালিকা হয়েছে। তালিকা ধরে শিগগিরই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কারা কর্তৃপক্ষ জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছে।
0 মন্তব্যসমূহ