সর্বশেষ আপডেট

3/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বরিশাল কারা হাসপাতালে লক্ষ লক্ষ টাকার বেড বানিজ্য : নেপথ্যে ডেপুটি জেলার ইব্রাহিম

 মোঃআনিসুল হক 



মামুনুর রশীদ নোমানী : বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে টাকা খরচ করলে সবকিছুই পাওয়া যায় কারা অভ্যান্তরে। শুধু খরচটা বাইরের চেয়ে দ্বিগুণ থেকে দশগুন। বন্দিদের দাবি, টাকা থাকলে কারাগারে রাজকীয়ভাবে বসবাস করা সম্ভব। ভালো খাবার থেকে শুরু করে মাদকদ্রব্য সবই পাওয়া যায় সেখানে। মাদক বিক্রি এবং বন্দিদের কাছ থেকে টাকা তোলার দায়িত্বে রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষের অনুগত ১০ থেকে ১৫ কারারক্ষী।
কারা হাসপাতালে সুস্থ্য হাজতি ও কয়েদীরা প্রতিমাসে বেড প্রতি চার হাজার পাঁচশত থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে থাকছেন। এসব টাকা বন্টন হয় কারা কর্মকর্তাদের মাঝে। এসবের নিয়ন্ত্রন করেন ডেপুটি জেলার ইব্রাহিম। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া একাধিক বন্দির সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই কারাগারে সকল ধরনের নেশা প্রবেশ করে। আরসি কিংবা কোকাকোলার বোতলে করে ভেতরে পাঠানো হয় ফেনসিডিল। আর মিনারেল ওয়াটারের বোতলে পাঠানো হয় সাদা (ওয়াটার কালার) রংয়ের মদ। এছাড়া ইয়াবা, গাঁজা ও ঘুমের ওষুধ সহজেই পাওয়া যায় কারাগারে। তবে দামটা বেশি দিতে হয়।

আমদানি ওয়ার্ড থেকে বন্দি বেঁচাকেনা, নিম্নমানের খাবার পরিবেশন, বন্দিদের মোবাইলে কথা বলার জন্য অর্থ আদায়, আর্থিক চুক্তিতে সুস্থ বন্দিকে অসুস্থ সাজিয়ে কারা হাসপাতালে রাখাসহ বিভিন্ন অনিয়মের ওপর ভর করেই চলছে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার।

মুক্ত হয়ে আসা হাজতিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বন্দিরা প্রথম দিন কারাগারে গেলে তাদের রাখা হয় আমদানি সেলে। পরে প্রয়োজনীয় অর্থ দিলে পাওয়া যায় হাসপাতাল কিংবা তুলনামূলক ভালো ওয়ার্ডে থাকার সুবিধা। বন্দিদের মোবাইলে কথা বলার জন্য বখশিসের নামে ৫০ থেকে ১০০ টাকা এমনকি এক প্যাকেট বেনসন সিগারেটও আদায়ের অভিযোগ রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ নিয়োজিত রক্ষীদের বিরুদ্ধে। প্রতি মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকার চুক্তিতে সুস্থ্য বন্দিদের অসুস্থ সাজিয়ে রাখা হয় তুলনামূলক আরামদায়ক জায়গা কারা হাসপাতালে।

জামিনে মুক্তি পেয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে এক বন্দি বলেন, ‘কারা হাসপাতাল কোনও অসুস্থ বন্দির জায়গা নয়। বিত্তবান সুস্থ্য বন্দিরা টাকার বিনিময়ে অসুস্থ হয়ে আরাম আয়েশে থাকেন সেখানে। কারা হাসপাতাল আর আবাসিক হোটেলের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এসবের নেপথ্যে রয়েছের দীর্ঘদিন বরিশাল কারাগারে দ্বায়িত্বরত ডেপুটি জেলার ইব্রাহিম।

কারাসূত্রে জানা যায়, খাবার তালিকা অনুযায়ী প্রতিদিন সকালে একজন কয়েদি ১১৬ গ্রাম ও হাজতির জন্য ৮৭ গ্রাম আটার রুটি এবং সবজিবা হালুয়া, দুপুরে কয়েদির জন্য ২৯১ গ্রাম ও হাজতির জন্য ২৪৭ গ্রাম চালের ভাত, ডাল, সবজি এবং ২৯ গ্রাম ওজনের মাছ অথবা মাংস দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। রাতেও প্রায় একই রকমের মেন্যু। প্রতিমাসে ২০ দিন মাছ এবং ১০ দিন মাংস খাওয়ানোর নিয়ম রয়েছে। ১০ দিনের মধ্যে আবার ৪ দিন গরু, একদিন খাসি এবং ৫ দিন মুরগির মাংস খাওয়ানোর কথা।

বন্দিদের দাবি, খাবারের এসব মেন্যু তালিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এখানে খাবারের মাপে কম দেওয়াসহ নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। রক্ষীদের নির্যাতনের ভয়ে কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করেন না।

কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়া হাজতি সাজ্জাত জানান, কারাগারে খাবারের মান অত্যন্ত নিম্নমানের। ভাত থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। তরকারি মুখে নেওয়ার মতো না। মাছ-মাংসও মানসম্পন্ন নয়। তাও নামে মাত্র। গোস্তের পিচ কিমার চেয়েও ছোট। হাসপাতালের রোগীদের গরুর দুধের বদলে গুড়ো দুধ গুলে খাওয়ানো হয়। যারা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল তারাই নিরুপায় হয়ে ওই খাবার খেয়ে থাকেন। স্বচ্ছল বন্দিরা কারাগারের কারা কেন্টিন থেকে অর্ডার দিয়ে পছন্দের খাবার খান। কারা কেন্টিনে প্রতিটি পন্যের মুল্য বাইরের থেকে দ্বিগুন থেতে চারগুন। বাইরে এক প্যাকেট হলিউড সিগারেট ৮০ টাকা অথচ কারা কেন্টিনে ১২৫ টাকা রাখা হয়। কারা হাসপাতাল তিন মাসের জন্য কারা কর্তৃপক্ষ থেকে কারা রক্ষীরা মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে ইজারা নেন।

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বন্দিদের মাধ্যমে জানা যায়, কারাগারে রেশনের দায়িত্বে রয়েছেন যে কারা রক্ষি তিনি সরবরাহকারীদের সঙ্গে আঁতাত করে ওজনে কম এবং নিম্নমানের রেশন গ্রহণ করে তা বেশি দামে হিসাবের খাতায় অন্তর্ভুক্ত করে আসছেন । কারাগারের বাইরের ক্যান্টিনে দ্বায়িত্বে থাকা কারা রক্ষি তিনি সেখানে উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি করেন । হাজতির ভর্তি ও মুক্তি শাখায় কর্মরত রয়েছেন দু কারা রক্ষি তারা দীর্ঘদিন ধরে একই পদে বহাল রয়েছেন। আর কারাগারের ভেতরের ক্যান্টিনে প্রতিমাসে ২৫-৩০ লাখ টাকার মালামাল বিক্রি হয় তাদের মাধ্যমে। কারা মহাপরিদর্শকের গোয়েন্দা কারারক্ষী টাকার বিনিময়ে এখানের কোনও তথ্য মহাপরিদর্শকের কার্যালয়ে পাঠান না। এভাবে ১০-১৫ জন কারারক্ষী নিয়মিত কারাগারে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে।

এছাড়া প্রতিদিন আদালত থেকে জামিনে বের হওয়ার সময় নামের বানানে ভুল কিংবা শারীরিক সনাক্তকরণ চিহ্নে সমস্যা, পিতার নাম কিংবা ঠিকানা ভুল অজুহাতে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা করে আদায় করা হয়।

করোনার জন্য আসামীদের স্বজনদের জন্য স্বাক্ষাৎ বন্ধ থাকায় কারাগারের অভ্যন্তরে অবস্থানরত আসামিদের সঙ্গে স্বজনদের মোবাইলে কথা বলার জন্য ৫০ থেকে ১০০ থেকে টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়। কারা অভ্যন্তরের মেডিক্যালে চিকিৎসার জন্য ৪২ জনের রোগীর সজ্জা থাকলেও সেখানে ভর্তি করা রয়েছে ২০০-২৫০ জনকে। প্রত্যেক ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদেরকে সেখানে থাকতে দেওয়া হচ্ছে। আর প্রতিমাসে বিভিন্ন খাত থেকে আদায় করা টাকা যাচ্ছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কারারক্ষী পর্যন্ত। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিমাসে অনৈতিকভাবে ২০ লাখ টাকা আয় রয়েছে। এসব অনৈতিক টাকার নেপথ্যে রয়েছেন ডেপুটি জেলার ইব্রাহিম। তবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

২০১৯ সালে এক কয়েদির আত্মহত্যা ও গত শনিবার এক হাজতির আত্মহত্যার পর বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে বরিশাল কারাগারের অনিয়ম ও দুর্নীতি। সম্প্রতি দুদকের একটি টিম কারাগারে অভিযান পরিচালনা করেছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বেসরকারি কারা পরিদর্শক কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা স্বীকার করে বলেন, এটা একদিনে হয়নি। বহুকাল ধরেই অনিয়মের ওপর ভর করে চলছে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়ম রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপার প্রশান্ত কুমার বনিক সকল অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি জানান, কারাগারের ভেতরে মাদকের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তারা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক তদারকি করে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে কোনও মাদক উদ্ধার হয়নি বলে তিনি জানান। টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

বরিশালের জেলা প্রশাসক ও কারাগার পরিদর্শন কমিটির সভাপতি এসএম অজিয়র রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বন্দিদের খাবারের মান উন্নত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্দি সুস্থ না অসুস্থ্য সেটা একজন সিভিলিয়ানের পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তাই কোন বন্দি কারা হাসপাতালে থাকবেন সেটা দেখেন কারা চিকিৎসক।’

মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বনের কথা উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক জানান, ‘কোনোভাবেই যেন কারাগারে মাদক প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তদারকি বাড়ানো হচ্ছে। মাদকের সঙ্গে কারও সংশ্লিস্টতার অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


https://barisalbani.com/%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b2-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%87-%e0%a6%b2%e0%a6%95/?fbclid=IwAR08O_jMOAxUv8sJhQJr7QQ8IFqYiEngZStHVikW8SiYk-0a3SuiEmBOA9A

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ