অন্ধকার অপরাধ জগত থেকে আলোকিত স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অনন্য এই উদ্যোগটি নিয়েছেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী। জীবনের গতিপথ বদলে দেয়া মানবিক এই উদ্যোগের নাম দেয়া হয়েছে, ‘কিশোরগঞ্জ কারাবন্দি সংশোধনাগার মডেল’। এর মাধ্যমে কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগার এখন এক আদর্শ সংশোধনাগারে পরিণত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ‘কিশোরগঞ্জ কারাবন্দি সংশোধনাগার মডেল’ কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে কারাবন্দিদের প্রশিক্ষণ ও কারামুক্তির পর তাদের পুনর্বাসনমূলক কার্যক্রম ভিত্তিক একটি উদ্যোগ যার লক্ষ্য কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারকে এক আদর্শ সংশোধনাগারে পরিণত করা এবং সাজাভোগ সমাপ্তির পর কারামুক্তদের সৎকর্মের মধ্য দিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করা।
উদ্যোগটি বাস্তবায়নে দুই ধাপে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে কারাভ্যন্তরে বন্দিকালীন সময়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে মুক্তির পর পুনর্বাসনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের স্বনিয়োজিত পেশার মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।
কারাবন্দিদের বন্দিকালীন অবস্থায় কৃষি, সেলাই, জুতা প্রস্তুতকরণ, নার্সারি, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা, মৎস্য চাষ, রন্ধন ও রেস্তোরাঁ ব্যবস্থাপনা, সংস্কৃতি চর্চা এবং ক্রীড়াচর্চা এই ৯ টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে দক্ষ প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে প্রথমে কারারক্ষী, জেলার ও ডেপুটি জেলারদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মাস্টারট্রেইনারে পরিণত করা হয়েছে। এরপর এই প্রশিক্ষিত মাস্টারট্রেইনারদের মাধ্যমে বন্দিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পাদনের লক্ষ্যে ৯টি ট্রেডভিত্তিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিটি ট্রেড এর জন্য ৭ দিন, ১৫ দিন ও ৩ মাসব্যাপী কোর্স চালু করা হয়েছে। প্রতি ট্রেডে প্রশিক্ষণের জন্য বন্দিদের মধ্যে ৩০ জন করে বাছাই করে একেকটি ব্যাচ গঠন করা হয়।
কারামুক্তির পর পুনর্বাসন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তিনজন কর্মকর্তা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি), অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও গোপনীয় শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কিশোরগঞ্জ জেলার ১৩ উপজেলার ১৩ জন উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগার এর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১ টি কারামুক্ত ব্যবস্থাপনা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এই ইউনিট এর মাধ্যমে কারামুক্তদের কর্মের সুযোগ, আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা, উন্নততর প্রশিক্ষণ, কারিগরি স্কুলে ভর্তির সুযোগ প্রদান করা হয়েছে।
পুনর্বাসনের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ‘রেডিয়েন্ট প্রিজনার্স (Radiant Prisoners)’ নামে একটি ওয়েবসাইট প্রস্তুত করা হয়েছে।
‘কিশোরগঞ্জ কারাবন্দি সংশোধনাগার মডেল’ উদ্যোগটি বাস্তবায়নের অংশীদার হিসেবে রয়েছে, কৃষি অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, শিল্পকলা একাডেমি, জেলা ক্রীড়া অফিস, কিশোরগঞ্জ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আমার বাড়ি আমার খামার এর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ এবং চেম্বার অব কমার্সসহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৯টি ট্রেডে ২৩৩ জন কারাবন্দিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৪ জনকে পুনর্বাসনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত করা হয়েছে।
যার মধ্যে ৭ জনকে সেলাই মেশিন, একজনকে সার ও বীজ প্রণোদনা, তিনজনকে আমার বাড়ি আমার খামার এর মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থ ঋণ এবং দুইজনকে ভৈরব উপজেলা প্রশাসন ও বাজিতপুর উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ২২ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
এছাড়া সংস্কৃতি চর্চায় প্রশিক্ষিত একজনকে চারটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে উপার্জন করা টাকা দিয়ে তিনি একটি মুদির দোকান চালু করেছেন।
অন্যদিকে কারাভ্যন্তরে ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কৃষি ট্রেডের প্রশিক্ষণার্থীদের মাধ্যমে ৭ লাখ ২৪ হাজার টাকার সবজি উৎপাদিত হয়েছে।
এছাড়া কারাভ্যন্তরে পাদুকা প্রস্তুতকরণ ট্রেডের প্রশিক্ষণার্থীদের মাধ্যমে ২৮ হাজার টাকার জুতা প্রস্তুতকরণ ও প্রস্তুতকৃত জুতা বিক্রয়ের মাধ্যমে পাওয়া লাভের শতকরা ৫০ ভাগ জুতা প্রস্তুতকারক প্রশিক্ষণার্থীদের দেয়া হয়েছে।
উদ্যোগটির বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, “১৬ কোটি মানুষের দেশের একটি বিশাল অংশ আজ নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে অলস দিন পার করছে। আর কারাবন্দিদের বেশির ভাগই কর্মক্ষম যুবক। ফলে দেশ একদিকে যেমন বড় একটা অংশকে কাজে লাগাতে পারছে না, অন্যদিকে তাদের ব্যবস্থাপনায় বিপুল সরকারি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। তাদের কাজে লাগাতে পারলে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখছি তা বাস্তবে রূপান্তর করা সহজ হবে। এ লক্ষেই কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারের কারাবন্দিদের কেন্দ্র করে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।”
প্রসঙ্গত, ১৯৪৮ সালে শহরের গাইটাল বটতলা এলাকায় মহকুমা কারাগারের যাত্রা শুরু হয়। ৭০ বছর পর ২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের পশ্চিমে সদর উপজেলার মারিয়া ইউনিয়নের খিলপাড়া এলাকায় কিশোরগঞ্জ-ভৈরব মহাসড়কের পাশে ২৮ একর জায়গার ওপর গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে নবনির্মিত জেলা কারাগারে বন্দি স্থানান্তর করা হয়।
এর আগে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নবনির্মিত কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
0 মন্তব্যসমূহ