এনএনইউ রিপোর্ট : ট্রেন থেকে মাদকসহ বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস গ্রেফতারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রদানের পরও টনক নড়েনি নারায়ণগঞ্জ কারাগারের মহা দূর্ণীতিবাজ সিন্ডিকেটের । চট্টগ্রামের ন্যায় নারায়ণগঞ্জ কারাগারে প্রতি মাস প্রায় তিন কোটি টাকার লক্ষমাত্রা নিয়ে নানাভাবে বন্দি/আসামী/ কয়েদীদের স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা । এ যেন লাগামহীণ দূর্ণীতির ঘোড়া । নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে লূটপাটের ভিডিও চিত্র অসংখ্যবার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নজড়ে আনা হলেও দূর্ণীতির লাঘামহীন ঘোড়া কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নাই ।
নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে কয়েদীদের সাথে পরিবার-পরিজনের সাক্ষাতের নামে চলছে অবৈধ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার রমরমা বাণিজ্য। জেল সুপার কিংবা জেলার পদে যখন যে বদলি হয়ে এই কারাগারের দায়িত্বে আসুক না কেনো, এ অবৈধ বাণিজ্যের ধারাবাহিতকা বজায় রাখেন প্রত্যেকে। শুধু তাই নয়, এই বাণিজ্যকে টার্গেট করে অনেকেই নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের দায়িত্ব নিতে বদলী হয়ে আসার অপেক্ষায় মোটা অঙ্কের ঘুষও দেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাধারনত বন্দীদের সাথে দেখা করার জন্য বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ওপেন ভাবে টিকিট প্রতি ১৫০/২০০ টাকা করে দিতে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে। এরপর টোকেন নিয়ে দেখা করতে হয় বিশাল জ্বালের এপাশ থেকে ওইপাশে।
অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই টিকিট টি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বিক্রি করা হচ্ছে। দেশের কোথাও কয়েদীদের সাথে দেখা করার জন্য কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনের নিয়ম নেই সরকারি ভাবে। অর্থাৎ নারায়ণগঞ্জ জেলা কারা কতৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে টিকিট ছাপিয়ে এনে তা দেখিয়ে সাধারন মানুষের থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে অত্যন্ত নিঁপুন ভাবে।
এছাড়া গেটে ঢোকার শুরুতেই হাতের মোবাইল ফোনটি জমা রাখার জন্য জনসাধারনকে দিতে হয় ৫/১০ টাকা করে। অথচ এই অর্থ আদায়েরও নেই কোনো সরকারি নিয়ম। বছর বছর পদ বদল হলেও বদলায় না এ বিশাল দুর্নীতি।
একইভাবে বন্দীদের সাথে আলাদা করে দেখা করার জন্য জনসাধারনকে গুণতে হয় ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা। দায়িত্বরত জেলারের নির্দেশে এই মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অফিস রুমেই দুই পক্ষের দেখা করার ব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে নিয়মিতই, এবং এর জন্য কয়েদীর আত্মীয়কে দেয়া হয়না কোনো টোকেন বা মানি রিসিট।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফতুল্লার দাপা ইদ্রাকপুর থেকে আসা এক কয়েদীর আত্মীয় জানান, জমি-জমা নিয়ে বিরোধের কারণে শত্রুপক্ষের দেয়া মিথ্যে মামলায় ২ বছর ধরে আমার ছেলে হাজতবাস করছে। এই ২ বছরে কোনোদিনই টাকা ছাড়া ছেলের সাথে দেখা করতে পারিনি। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে দেখা করতে পারলেও জালের এপাশ থেকে ওইপাশে ছেলেকে অন্ধকারে ঠিকমতো দেখতে পারিনা, কথাও ঠিকমতো বলতে পারিনা। তাই অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে মাসে অন্তত ১/২ বার হলেও ১৩০০-১৪০০ টাকা খরচ করে জেলার সাহেবের অনুমতি নিয়ে অফিস রুমে ছেলেকে ডেকে এনে দেখা করি।
একই অভিযোগ সৈয়দপুর থেকে আসা এক আসামীর স্ত্রীর। তিনি বলেন, যতবারই জেলখানায় আসি স্বামীর সাথে দেখা করতে, ততবারই টাকা নিয়ে আসতে হয়। মেইন গেট দিয়ে ঢোকা থেকে শুরু করে স্বামীর সাথে কোনোমতে দেখা করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পর্যন্ত সবখানে টাকা দিতে হয়। যেদিন স্বামীর সাথে দেখা করতে আসি, সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়ে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয় টাকার অভাবে।
এদিকে এসব অর্থ নেয়ার সরকারি কোনো নিয়ম নেই, তার পরও কেনো তারা আসামীর সাথে দেখা করার জন্য অর্থ খরচ করছে জানতে চাইলে অবাক হয়ে এ প্রতিবেদককে জানান, ‘আমরা তো জানি বন্দীদের সাথে কারাগারে দেখা করতে এলেই টাকা দিতে হয় এবং এটাই নিয়ম। কখনো এই নিয়মের বন্ধ হতে দেখিনি’।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দায়িত্বরত এক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, সাংবাদিকতায় আসারও বেশ আগে খুব কম বয়স থেকেই যখন গার্ডিয়ানদের সাথে কারাগারে আসতাম কোনো দুর সম্পর্কের আত্মীয়কে দেখতে, তখনো অর্থের বিনিময়েই দেখা হতো। এরপর যখন সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে বিভিন্ন সময় মামলার কারণে কারাবরণ করা সহকর্মীদের সাথে দেখা করতে গিয়েছি, তখনো একইভাবে অর্থের বিনিময়ে দেখা করতে হয়েছে। সুতরাং এটি কতটুকু বৈধ বা অবৈধ ছিল তা নিয়ে তখন ভাববার মতো অবস্থা ছিলনা। কারণ, সেখানে অর্থের বিনিময়ে টিকিট দেয়া হতো, যা নিয়ে আমরা কয়েদীদের সাথে দেখা করতে যেতাম। কিন্তু পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে এসবের কোনো সরকারি নিয়ম নেই।
‘তবে কেনো এসব দুর্নীতি নিয়ে সংবাদকর্মী ও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কোনো উদ্যোগ নেন নি’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে আমি কিংবা আপনি একার পক্ষে বছরের পর বছর ধরে চলা এ অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে একা লড়াই করে কিছুই করতে পারব না। কেননা, অর্থলোভি কতিপয় দুর্নীতিবাজ সংবাদকর্মীও রয়েছেন এর পেছনে। যারা নিয়মিত অর্থের বিনিময়ে সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করেন।
সাধারন মানুষকে বোকা বানিয়ে এভাবেই বছরের পর বছর ধরে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারা কতৃপক্ষ। স্থান ভেদে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন জেলার কারাগারগুলোতেও চলছে একই দৃশ্য।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষের সাথে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ”বন্দীদের সাথে দেখা করার জন্য আমার কারাগারে কোনো ধরনের টাকা নেয়া হয় না। এই নিয়ম বাংলাদেশের কোনো কারাগারে নেই। কেউ যদি এভাবে টাকা নিয়ে থাকে তাহলে তা আমার জানার বাইরে”।
এর কিছুক্ষণ পরেই একাধিকবার জেল সুপার এ প্রতিবেদককে কল ব্যাক করে বার বার অনুরোধ করেন- কারাগারের দুর্নাম হয় এমন সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য।
তবে জেলার আসাদুর রহমান বলেন, ”আসলে সরকারি ভাবে অর্থের বিনিময়ে কয়েদীদের সাথে দেখা করার নিয়ম নেই। আমরা কারাগারের স্বার্থেই এই অর্থগুলো নিচ্ছি। কেননা কারাগারের উন্নয়নে সরকারি বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফলে এখান থেকে অর্থ নিয়েই কারাগারের বিভিন্ন উন্নয়নে তা খরচ করতে হচ্ছে”।
তিনি দাবি করেন, ”এই অর্থটুকু দিতে কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বরং এই আয় দিয়ে কারাগারের বিভিন্ন সংস্কার কাজ থেকে শুরু করে উন্নয়নমূলক নানা কাজ করা হচ্ছে। বিশেষ করে এই আয় থেকে আমরা কারাগারে একটি মিনি গার্মেন্ট চালু করেছি। যেখানে জামদানী ও অন্যান্য কারুপন্য তৈরি করছে অন্তত ৩০০ থেকে ৪০০ কারাবন্দী। একদিকে তাদের সংশোধন হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের আয় হচ্ছে। এসব কিছুর জন্য সরকারি ভাবে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাইনা আমরা, ফলে বন্দীদের সাথে দেখা করতে আসা লোকজনের থেকে নেয়া অর্থের অংশ দিয়েই এসব কাজ করা হয়”।
তবে তিনিও একইভাবে সংবাদটি প্রকাশ না করার জন্য এ প্রতিবেদককে অনুরোধ করেন।
https://nganjnewsupdate.com/2018/11/02/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%87/?fbclid=IwAR0UrJ7_uLbkAj-to0g4jJRASO2Wy-XRm_gakpyb9C5MBlclBcOh4aHcPKU
0 মন্তব্যসমূহ