ইয়াবা সিন্ডিকেটের দখলে মোবাইল ফোন : সদ্য কারামুক্ত কয়েকজন বন্দি প্রতিদিনের কাগজকে জানান, সরকার সাধারণ বন্দিদের জন্য কারাগারে ১৬টি মোবাইল ফোন দিয়েছে। নিয়ম অনুয়ায়ী ৫ টাকা দিয়ে প্রত্যেক বন্দি সপ্তাহে একবার পরিবারের (এক কল) সঙ্গে ১০ মিনিট করে কথা বলতে পারেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ প্রতি ১৫ দিনের জন্য আড়াই লাখ টাকা জামানত (অফেরতযোগ্য) নিয়ে ৮টি মোবাইলই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছে। এসব মোবাইলের ভাড়া বাবদ আদায় করা হয় দৈনিক ৮০ হাজার টাকা থেকে ৯০ হাজার টাকা । ওই মোবাইলে কথা বলতে বন্দিদের প্রতি ৫ মিনিটের কলে ২৫০ টাকা করে নিচ্ছে তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারের টেলিফোন অবৈধভাবে লিজ দেওয়া হয়েছে ইয়াবা কারবারিদের কাছে। দৈনিক ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার বিনিময়ে এ লিজ নিয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট। সরকারি হিসাবে দৈনিক গড়ে আসামিদের সঙ্গে ৬০০ থেকে সাড়ে ৭০০ লোক কথা বলার নিয়ম থাকলেও এ কারাগারে দৈনিক কথা বলেন ১৫শ জন। এছাড়া নিয়মবহির্ভূত ভাবে চলছে মোবাইল বাণিজ্য। এছাড়া নতুন বন্দিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ আছে। নতুন টাকাওয়ালা যারা কারাগারে ঢোকেন তাদের ভয় দেখিয়ে সেলে রেখে জনপ্রতি ৫ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা আদায় করেন করা হয় । এদিকে আসামিরা সাধারণ ওয়ার্ডের কোথায় থাকবেন, কতটা ভালো থাকবেন, কী খাবার খাবেন-তা নির্ভর করে একজন সুবেদার সিন্ডিকেটের ওপর। টাকার পরিমাণ বিবেচনায় নতুন আসামিদের সুযোগ-সুবিধা করে দেয় এ সিন্ডিকেট। টাকা দিতে রাজি না হলে নতুন বন্দিদের অহেতুক আলাদা করে রাখা হয়। টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত খাবার ও গোসল ঠিকমতো করতে দেওয়া হয় না। কারাগারে যেভাবে ঢুকে টাকা : হাজতি বা কয়েদিদের নগদ টাকা প্রয়োজন হলে কারারক্ষীদের মাধ্যমে যত টাকা ই”ছা কারাগারে ঢুকানো যায়। এক্ষেত্রে প্রতি হাজারে কারারক্ষীদের কমিশন দিতে হয় ২৫০ টাকা।
কারা হাসপাতাল ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে : কক্সবাজার কারাগারে দোতলা একটি হাসপাতাল আছে। সেখানে অসুস্থ কারাবন্দিরা ঠিকমতো চিকিৎসা পান না। ওষুধ চাইলে পরে দেওয়া হবে, নতুবা নেই বলে খালি হাতে ফেরত পাঠানো হয়। হাসপাতালের ওষুধ বিক্রি ও বন্দিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে ফার্মাসিস্টের বিরুদ্ধে। অর্থনৈতিকভাবে স”ছল বন্দিরা মাসিক ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা করে ফার্মাসিস্টদের দায়িত্বে থাকা একজন কারারক্ষী দিয়ে হাসপাতালে আবাসিক হোটেলের মতো বাস করেন। খাবারও খান ভালোমানের। আর প্রকৃতপক্ষে যারা অসু¯’ তাদের হাসপাতালের মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ওই হাসপাতালে স্থায়ী কোনো চিকিৎসক নেই। সরকারি অন্য হাসপাতালে কর্মরত একজন চিকিৎসক মাঝেমধ্যে কারা হাসপাতাল আসেন। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা টাকার বিনিময়ে কারা হাসপাতাল তাদের দখলে রেখেছে।
জেলখানার ভেতরে একপাশে তৈরি করা হয়েছে কারা ক্যান্টিন। সেখানে কয়েকশ হাজতি ও কয়েদির পছন্দমতো খাবার রান্না হয়। ক্যান্টিনে ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রির নিয়ম থাকলেও ৫-১০ গুণ দাম নেওয়া হয়। প্রতিদিনের কাগজের অনুসন্ধানে জানা যায়, ৭০০ বন্দির ধারণক্ষমতার কারাগারে বর্তমানে ৩৫০০ বেশি বন্দি থাকেন। বন্দিদের জন্য দৈনিক খাদ্য তালিকা অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয় না। ক্যান্টিন ও ওয়ার্ডে সিট বাণিজ্য : সদ্য কারামুক্ত একজন যুব লীগ নেতা বলেন, কারাগারের সাগর ভবন আমদানি ওয়ার্ড নামে পরিচিত ১নং ওয়ার্ডে ১০০ আসামি থাকেন। সেখানে প্রতিজনের কাছ থেকে মাসে নেওয়া হয় ৪ হাজার টাকা করে। অন্য ভবনগুলোতে প্রতিমাসে দিতে হয় ৩ হাজার টাকা করে। সব ওয়ার্ডে একই অব¯’া। হাসপাতালে সাধারণ বন্দিদের চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে মাসের পর মাস থাকে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। তাদের খাবার ও রান্না করা হয় হাসপাতালের রান্নাঘরে।
একজন কারারক্ষী জানান, ভেতরে থাকা কেন্টিন কারারক্ষীদের ভাড়া দেওয়া হয়। এজন্য প্রতি ২ মাসে ১২ লাখ টাকা ঘুষ ছাড়াও মাসে ২৫ লাখ টাকা করে ভাড়া দিতে হয় জেল সুপার শাহ আলম খানকে। টাকা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন জেল সুপারের ড্রাইভার ও তার দেহরক্ষী । অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারের বন্দিদের প্রাপ্য সরকারি বরাদ্দ করা চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের সিংহভাগই লুটপাট হয়। নির্দেশনা অনুসারে প্রতিদিন সকাল, দুপুর, বিকালে যে পরিমাণ খাবার পাওয়ার কথা তা কখনোই দেওয়া হয় না বন্দিদের। জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্তরা জানান, জেল সুপার শাহ আলম খান ইচ্ছে অনুযায়ী রান্না হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মাছের মাথা দিয়ে সবজি রান্না, ব্রয়লার মুরগি দিয়ে ডাল এবং দুপুরের সবজির বদলে আলু রান্না করে খাওয়ানো হয়। আর এসব তরকারি বিতরণের সময় জেল সুপারের সিন্ডিকেটের সদস্যরাই নিজে উপস্থিত থাকেন। যেন কোনো বন্দি এর প্রতিবাদ করতে না পারেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপরে নেমে আসে নির্যাতন।
অভিযোগ আছে, জেল সুপার শাহ আলম খান এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। কারাগারে কর্মরত থেকে তিনি অবৈধ পথে প্রায় ২০ কোটি টাকা সম্পদ করেছেন। নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাব খুলেছেন । রেখেছেন কোটি কোটি টাকা। কিনেছেন রাজধানী সহ নিজ এলাকায় কয়েক কোটি টাকার জমিজমা। অভিযোগের বিষয়ে জেল সুপারের বক্তব্য : জানতে চাইলে জেল সুপার মোঃ শাহ আলম খান প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, ‘আমার কারাগারে মোবাইল, ইয়াবা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চালু থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ আপনি কারাগারের ক্যান্টিন থেকে প্রতিমাসে ৩০ লাখ টাকা নেন- এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান তিনি। গরুর মাংস কেজি দুই হাজার দুইশ ও মুরগির মাংস কেজি এক হাজার দুইশ টাকা ও আলুর কেজি ৩০০ টাকা বিক্রি হয় কিভাবে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিষয়টি দেখে ব্যবস্থা নেব। কারাগারে ইয়াবা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মোবাইল কলের ব্যবসা করে এবং প্রতিদিনই আপনাকে ৯০ হাজার করে টাকা দিতে হয়-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি প্রতিবেদককে ভাই বলে কারাগারের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান
0 মন্তব্যসমূহ